আমাদের দৈনন্দিন প্রয়োজনে আমরা প্রায় সবাই স্মার্টফোন ব্যবহার করছি এবং স্মার্ট ফোনের ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে। প্রায় প্রত্যেকটি কাজে, কারণে-অকারণে আমরা মোবাইল ফোনটি পকেট থেকে বের করে হাতে নিয়ে নিচ্ছি। অনেক সময় আমরা আমাদের স্মার্টফোনটি হাতে নিয়ে নিই কোন কারণ ছাড়াই। এসব দেখে দেখে আমাদের শিশু শিখছে। অনেক সময় শিশু কান্না করলে তাকে আমরা স্মার্টফোনটি তার হাতে ধরিয়ে দিই এবং তাকে খাওয়ানোর জন্যও এই টেকনিকটা ব্যবহার করে থাকি।
বিভিন্ন কারণে-অকারণে অভিভাবকরা শিশুর হাতে মোবাইল ফোন তুলে দেন। সেটা নিয়ে সে খেলতে খেলতে মোবাইল ফোনের ওপর আসক্তি তৈরি হয়ে যায়। বাইরে অন্য শিশুদের সাথে খেলতে না গিয়ে আপনার শিশু স্মার্টফোন নিয়ে বসে থাকে, ফলে অন্য শিশুদের সাথে তার বন্ধুত্ব গড়ে উঠে না সে কারনে সে আরো মোবাইল কেন্দ্রিক হয়ে পরে । খাবার সময়ও তার মোবাইল ফোন চাই। এভাবে চলতে থাকলে অজান্তেই শিশুর নানা রকম শারীরিক ও মানসিক ক্ষতি হয়ে যায়।
শিশুদের মোবাইল ফোনে আসক্তি নিয়ে বিভিন্ন গবেষণায় বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উঠে এসেছে:
১. মস্তিষ্কের উন্নয়নে বাধাগ্রস্ত: শিশুদের মস্তিষ্কের বিকাশে মোবাইল ফোনের অতিরিক্ত ব্যবহার নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। এটি শিশুর একাগ্রতা, মনোযোগ এবং সমস্যা সমাধানের দক্ষতা হ্রাস করতে পারে।
২. শারীরিক সমস্যা: দীর্ঘক্ষণ মোবাইল ফোন ব্যবহারের ফলে শিশুদের চোখের সমস্যা, ঘাড় এবং হাতের ব্যথা হতে পারে।
৩. ঘুমের সমস্যা: মোবাইল ফোনের নীল আলো ঘুমের মান কমিয়ে দেয়। শিশুদের পর্যাপ্ত ঘুম না হলে তাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।
৪. মানসিক স্বাস্থ্য: মোবাইল ফোনের অতিরিক্ত ব্যবহারে উদ্বেগ, বিষণ্ণতা, এবং একাকীত্বের অনুভূতি বৃদ্ধি পেতে পারে। বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অতিরিক্ত সময় কাটানোর ফলে এই সমস্যাগুলো বাড়তে পারে।
৫. আচরণগত সমস্যা: শিশুদের মধ্যে মেজাজের পরিবর্তন, আগ্রাসী আচরণ এবং একাগ্রতার অভাব দেখা দিতে পারে। এছাড়া, মোবাইল আসক্তি স্কুলের পারফরম্যান্স কমিয়ে দিতে পারে।
৬. সামাজিক বিচ্ছিন্নতা: মোবাইল ফোনে আসক্তি শিশুদের সামাজিক দক্ষতা কমিয়ে দিতে পারে। তারা পরিবারের সাথে সময় কাটানো বা বন্ধুদের সাথে খেলার পরিবর্তে মোবাইলেই বেশি সময় কাটায়।
৭. শিক্ষাগত প্রভাব: মোবাইল ফোনের আসক্তির কারণে শিক্ষার্থীরা পড়াশোনায় মনোযোগ কম দিতে পারে এবং পরীক্ষার ফলাফল খারাপ হতে পারে।
৮. আলোর প্রতি সংবেদনশীলতা: মোবাইল ফোনের স্ক্রিনের আলোতে বেশি সময় কাটানোর ফলে চোখের সমস্যা বৃদ্ধি পেতে পারে, যেমন দৃষ্টি ঝাপসা হওয়া বা চোখের শুষ্কতা।
এসব সমস্যার সমাধানে এবং শিশুদের মোবাইল ফোনের আসক্তি নিয়ন্ত্রণে অভিভাবকদের দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। নিয়মিত পর্যবেক্ষণ ও সচেতনতার মাধ্যমে শিশুদের মোবাইল ফোন ব্যবহারের উপর নিয়ন্ত্রণ আনা সম্ভব। চলুন উপায়গুলো দেখে নিই, কিভাবে শিশুদের মোবাইলের আসক্তি দূর করা যায়।
আরও পড়ুন: ক্রোম ব্রাউজারে পর্ণ বা প্রাপ্ত বয়স্ক কন্টেন্ট কিভাবে বন্ধ করবেন?
শিশুর সামনে স্মার্টফোন ব্যবাহার করবেন না
শিশুরা অনুকরণপ্রিয়, বড়রা কিভাবে কি করে তা হুবহু কপি করতে চেষ্টা করে। বাচ্চারা সবসময় কৌতুহলদ্দীপক, তারা জানতে চায়, বুঝতে চায়, শিখতে চায়। বড়দের হাতে স্মার্টফোন দেখলে সেও অবশ্যই তা নিতে আগ্রহ পায়। তাই বাচ্চাদের সামনে স্মার্টফোন ব্যবহার এড়িয়ে চলুন, যেমন-গান শোনা, চ্যাট করা, ভিডিও দেখা ইত্যাদি।
আপনার শিশুকে আপনি ছাড়া আর কে ই বা বেশি ভালোবাসে বলেন। আপনি চাইলে আপনার শিশুকে মোবাইল আসক্ত থেকে দূরে রাখতে পারেন। আপনি হয়ত ভাবছেন ১বার ২বার শিশুর হাতে মোবাইল তুলে দিলে কি বা ক্ষতি হবে। আপনি ছাড়াও আপনার পরিবারের অন্য সদস্যারাও কিন্তু আপনার আদরের সন্তান থেকে দূরে নয়, তারাও এই সেইম জিনিসটাই করছে। তাই যতটুকু সম্ভব আপনার সন্তানকে তা থেকে দূরে রাখুন।
শিশুকে বাহিরে খোলা আকাশের নিচে নিয় যান
শিশুদের মধ্যে সবসময় একটা দুরন্তপনা কাজ করে। সুযোগ পেলেই ছুটে চলতে চায়, মেতে উঠতে চায় দুরন্তপনায়। খেয়াল করে দেখবেন আপনি তাকে খোলা জায়গায় নিয়ে গেলেই সে দেয় এটা ভোঁ-দৌড়, যেন তাকে পৃথীবির কেউ আটকাতে পারবে না। আপনার শিশুকে স্মার্টফোন আশক্তি থেকে দূর করার জন্য নিচের লাইনগুলো চেক করে নিতে পারেন।
১. শিশুকে খোলা আকাশের নিচে খেলাধুলার সুযোগ দিন।
২. পার্কে নিয়ে যান, সেখানে বিভিন্ন খেলা খেলার সুযোগ থাকবে।
৩. বাগানে নিয়ে গাছপালার পরিচর্যা করতে দিন।
৪. সাইকেল চালানো শিখাতে পারেন।
৫. পিকনিকের আয়োজন করুন।
৬. হাইকিং বা ট্রেকিংয়ে নিয়ে যান।
৭. বাইরের হাওয়ায় হাঁটার ব্যবস্থা করুন।
৮. পরিবারের সাথে ব্যাডমিন্টন, ফুটবল বা ক্রিকেট খেলুন।
৯. নদীর ধারে বেড়াতে নিয়ে যান।
১০. শিশুকে মাছ ধরার প্রশিক্ষণ দিন।
১১. শহীদ মিনার বা জাতীয় জাদুঘরের মত জায়গায় নিয়ে যান।
১২. শিশুকে চিড়িয়াখানায় নিয়ে যান।
আর পড়ুন: যে ১০টি জিনিস কখনো সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করা উচিৎ নয়
১৩. খোলা মাঠে কাইট ফ্লাইং করাতে পারেন।
১৪. বোটিং বা নৌকাবিহার করাতে পারেন।
১৫. শিশুকে বাগান করার জন্য একটি ছোট প্লট দিতে পারেন।
১৬. বাইরের জায়গায় ক্যাম্পিং করুন।
১৭. পশুপাখি দেখানোর জন্য ফার্মে নিয়ে যান।
১৮. বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ কেন্দ্রে নিয়ে যান।
১৯. মেলা বা প্রদর্শনীতে নিয়ে যান।
২০. স্থানীয় ক্রীড়া ইভেন্টে অংশ নিতে উত্সাহিত করুন।
২১. পাহাড়ি এলাকায় নিয়ে যান।
২২. ফুল বাগানে নিয়ে ফুলের পরিচর্যা করতে দিন।
২৩. গ্রামে নিয়ে যান, গ্রামের জীবনধারা দেখার সুযোগ দিন।
২৪. শিশুকে পুকুরে বা সুইমিং পুলে সাঁতার শেখাতে পারেন।
২৫. ফ্যামিলি রিক্রিয়েশন সেন্টারে নিয়ে যান।
২৬. অ্যাডভেঞ্চার স্পোর্টস করাতে পারেন।
২৭. দৌড় প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে উত্সাহিত করুন।
২৮. শিশুকে আলাদা সময় দিন, গল্প বলুন।
২৯. আকাশের তারা দেখতে রাতে বাইরে নিয়ে যান।
৩০. স্থানীয় ধর্মীয় উৎসব বা মসজিদ, মন্দির বা গীর্জায় নিয়ে যান।
৩১. তাকে ছোটোখাটো ঘুড়ি বানাতে শিখান।
৩২. শিশুকে প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখতে পাহাড়ের চূড়ায় নিয়ে যান।
৩৩. শিশুদের জন্য বিশেষভাবে নির্মিত বোটানিক্যাল গার্ডেনে নিয়ে যান।
৩৪. সমুদ্র সৈকতে নিয়ে যান।
৩৫. শিশুকে নাট্য প্রদর্শনীতে নিয়ে যান।
৩৬. গ্রামের খেলার মাঠে নিয়ে যান।
৩৭. তার সাথে শরীরচর্চা করুন।
৩৮. তার সাথে নানান ধরণের অ্যাডভেঞ্চার করুন।
৩৯. তার সাথে প্রজাপতি ধরার খেলা খেলুন।
৪০. শিশুকে তার বন্ধুদের সাথে খেলা করতে বাইরে পাঠান।
এসব পদ্ধতি অনুসরণ করে শিশুদের মোবাইল ফোনের আসক্তি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব এবং স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন নিশ্চিত করা যায়।